চোখের সামনেই ব্যাক্টেরিয়ার যে বিবর্তন ঘটে চলেছে, আজকাল গোড়া বিবর্তনবিরোধীরাও সেটা স্বীকার করে নেয়। এরপর যথারীতি যেটা দাবি করে সেটা হচ্ছে যে একটা ব্যাক্টেরিয়ার জিনোম বিবর্তিত হলে বড়জোর আরেকটা ব্যাকটেরিয়াই তৈরি হয়, সেখান থেকে সাপ-ব্যাঙ দূরে থাক, একটা মশা-মাছিরও উদ্ভব হতে পারে না। এমনটা এরা বলে থাকে হয়ত এটা না বুঝেই যে কত ধীরে বিবর্তন সংঘটিত হয় এবং ইভল্যুশনারি স্কেলে ছোট ছোট পরিবর্তন যূথবদ্ধ হয়ে কত ভিন্ন একটা প্রাণীর জন্ম দিতে পারে। এদের সবাই যে এ সামান্য ব্যাপারটা বোঝে না তা নয়, বোঝা সত্ত্বেও এমনকি কিছু তথাকথিত বিজ্ঞানীও তাদের বইপত্রে এমনটা লিখে থাকেন। সে যাকগে, টাকা খেয়ে বিভ্রান্তিকর লেখা ওরা লিখুক গিয়ে, সত্যিটা জানবার পথ তো এখনো খোলা আছে পাঠকের। তো, আসুন দেখি, ছোট্ট একটা বাস্তব উদাহরণ দিয়ে প্রাকৃতিক নির্বাচনের শক্তি কতটা জেনে নিই।
Soapberry পোকার (Jadera haematoloma) শুঁড়ের বিবর্তনের কথা বলছি। যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন অঞ্চলে দু’টি আদি প্রজাতির উদ্ভিদে পোকাগুলোর আবাস। একটি হচ্ছে দক্ষিণ-মধ্য যুক্তরাষ্ট্রের সোপবেরি ঝোপ (Soapberry bush), অন্যটি গুল্মজাতীয় একটি বারোমাসী উদ্ভিদ (Balloon vine)। সূঁচ ফোটানোর মতো করে পোকাটি ওর লম্বা সরু শুঁড়টিকে ফলের মধ্যে বিঁধিয়ে দেয়, এরপর বীজের উপাদানগুলো একধরনের হজমকারী লালারসের সাহায্যে গলিয়ে শুষে খায়। গত পঞ্চাশ বছরে এদের বিচরণ এলাকায় বিভিন্ন প্রজাতির নতুন উদ্ভিদের আমদানি হয়েছে। পোকাগুলো এধরনের তিনটি প্রজাতির উদ্ভিদে স্থানান্তরিত হয়ে নতুন কলোনি তৈরি করেছে। এই নতুন উদ্ভিদগুলোর ফল আদিগুলোর চেয়ে আকারে ভিন্নতরঃ দু’টির আকৃতি অনেক বড় এবং অন্যটি অনেক ছোট।
বেলুন ভাইনের ফলে সোপবেরি বাগ
সোপবেরি পোকা নিয়ে গবেষণারত স্কট ক্যারল ও তার সহকর্মীরা ভবিষ্যদ্বানী করেছিলেন যে এই আবাসনের পরিবর্তনের ফলে প্রাকৃতিক নির্বাচন মেনে পোকাগুলোর শুঁড়ের আকৃতি পরিবর্তিত হবে। যে পোকাগুলো বড় ফলের উদ্ভিদগুলোতে আশ্রয় নিয়েছে, সেগুলোর শুঁড় আকারে আরো লম্বা হবে যাতে করে ফল ভেদ করে এর বীজ খেতে পারে। অন্যদিকে ছোট ফলের গাছে আশ্রয় নেয়া পোকাগুলোর শুঁড়ের বিবর্তন হবে ঠিক এর উল্টো দিকে। ঠিক এমনটাই ঘটেছে, মাত্র কয়েক দশকের মধ্যেই শুঁড়ের দৈর্ঘ্য ২৫% বদলে গেছে। মনে হতে পারে এ আর এমন কী, তবে বিবর্তনের মাপকাঠিতে মাত্র ১০০ প্রজন্মের মধ্যে এরকম পরিবর্তন রীতিমত প্রকাণ্ড। ভাবুন একবার, বিশ বছরে এক প্রজন্ম ধরলে মাত্র দুই হাজার বছরের মধ্যেই ছয় ফুটের ডাচরা লম্বায় বেড়ে দাঁড়ালো সাড়ে সাত ফুটে! লাখ খানেক বছর ধরে একইরকম বাড়তে থাকলে কোথায় পৌঁছবে ওরা ভাবুন একবার!
ছবিতে দেখুন, উপরেরটি এশিয়া থেকে আনা ফলজ উদ্ভিদের পোকা, নিচেরটি আদি উদ্ভিদের। পাশের স্ক্যাটার প্লট থেকে দেখুন শুঁড়ের দৈর্ঘ্য কালান্তরে কীভাবে ছোট হয়ে আসছে।
ছোট্ট একটা তুলনা করলে ব্যাপারটা আরো পরিষ্কার হবে। একই হারে যদি ওই পোকাগুলোর বিবর্তন হতে থাকে আগামী দশ হাজার প্রজন্ম ধরে (সময়ের হিসাবে ৫,০০০ বছর), তাহলে শুঁড় লম্বায় বেড়ে যাবে পাঁচশ কোটি গুণ, দৈর্ঘ্যের হিসাবে যেটা ১,৮০০ মাইল, যার সাহায্যে পোকাটি চাঁদের সমান একটা ফল ফুটো করে খেতে পারবে! এখানে বলে রাখা উচিত, এই তুলনার মানে কিন্তু এটা না যে ওদের শুঁড় বাড়তে বাড়তে একসময় আসলেই এত বড় হয়ে যাবে, বরং এটা দেখানো যে বিবর্তনের মানদণ্ডে এই সামান্য পরিবর্তনই কালক্রমে প্রজন্মান্তরে কত বড় হয়ে উঠতে পারে। বস্তুত অধিকাংশ সময়ই বিবর্তন ঘটে এর চেয়ে অনেক ধীরে – বিশেষত যেসব জীবের আয়ু অপেক্ষাকৃত দীর্ঘ (ব্যাক্টেরিয়া বা সোপবেরি পোকার চেয়ে তো অবশ্যই) – এক মানবজীবনের আয়ুস্কালে যেটা বোঝা দুঃসাধ্য। গত কয়েক দশকে পোকাগুলোর যে বিবর্তন ঘটেছে, এটাও একটা পর্যায়ে গিয়ে ধীর হয়ে গেছে। এভাবেই চলবে যতদিন না এদের বিচরণ এলাকায় কোন পরিবর্তন হচ্ছে যাতে করে বেঁচে থাকার জন্য এদের নতুন করে অভিযোজনের তাগিদ অনুভূত হয়।
====================================================
তথ্যসূত্রঃ Jerry A. Coyne, Why Evolution Is True, 1st Edition, p. 146


Leave a comment