ছোটবেলা ক্লাস সেভেনে প্রথমবার শামসুর রহমানের ‘স্বাধীনতা তুমি’ কবিতা পড়ার সময় কবি নজরুলের মতো ‘ঝাঁকড়া চুলের বাবরি দোলানো মহান পুরুষ’ হতে চেয়েছিলাম। ক্লাস এইট পর্যন্ত পিতার কড়া শাসনে ৩ ইঞ্চির বেশি চুল বড় রাখা হয়ে ওঠে নি। এরপরের চারটি বছর ডিআরএমসি’র অমানুষিক শৃঙ্খলে বন্দী হয়ে চুলের দৈর্ঘ্য সর্বোচ্চ ১ ইঞ্চিতেই সীমিত রাখতে হয়েছিলো। অতঃপর বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে এসে যখন চুল বড় রাখতে আরম্ভ করবো করে, ঠিক তখনই শুরু হলো চুল পড়া। প্রথম দুই সেমিস্টারে যে হারে চুল পড়ে চুলের সংখ্যা অর্ধেকে এসে ঠেকলো, তাতে করে ভেবেছিলাম ৮ সেমিস্টার শেষ হবার আগেই বুঝি সব ঝড়ে যাবে। বিধাতার কৃপায় কীভাবে যেন অলক-পতনের হার কমে গেলো; একগাছি চুল নিয়েই বিশ্ববিদ্যালয় হতে বেরুতে পারছি, এটাই বা কম কী?
চুল পড়া ঠেকাতে লোকে কত না কাঠখড় পোড়ায়, আর আমি সেখানে একটা দেশলাইও খরচ করি নি। তবে চুল পড়ার কারণ অনুসন্ধানে আমার আগ্রহ দমে নি বিন্দুমাত্র। গুগল দা’র কল্যাণে বিভিন্ন সোর্স থেকে ফ্রি-তে যেটা জানলাম, চুল পড়ার মূখ্য কারণ হেয়ার ফলিকলের পুষ্টিহীনতা। এটাও আবার ঘটে বেশ কিছু কারণে, চুল পড়ার প্যাটার্ন দেখে সেটা বোঝা যায়। ৫’৭” উচ্চতা, ৬৫ কেজির নিরোগ সুঠামদেহ (উদরাঞ্চলে মেদের বাহুল্য দেখে অবশ্য দুর্মুখেরা বাজে কথা বলে) নিয়ে ভাববার কোনই কারণ নেই যে আমি অপুষ্টিতে ভুগছি। বয়ঃসন্ধি পার হবার পরপরই চুল পাতলা হয়ে যাওয়া ও হেয়ারলাইনের হঠাৎ পশ্চাদ্গমন দেখে যেটা আঁচ করলাম, আমার ধরণটা আসলে মেইল প্যাটার্ন বল্ডনেস (male pattern baldness)। এটার জন্য দায়ী মূলত ডাইহাইড্রোটেস্টস্টেরোন (Dihydrodestosterone, বা সংক্ষেপে DHT) নামের একটা সেক্স হরমোন এবং হেয়ার ফলিকলের মধ্যে অবস্থিত DHT receptor যেটা কিনা জেনেটিক্যালিই কারো কারো বেশি মাত্রায় থাকে। আমার বাবা-মা দুই পরিবারেই মেইল প্যাটার্ন বল্ডনেস আছে, কিন্তু মামাদের মাথার অবস্থা দেখে আমার ধারণা আমার মায়ের থেকেই এটা পেয়েছি। সে যাইহোক, DHT যখন DHT receptor দ্বারা আকৃষ্ট হয়ে ফলিকলের নিচে প্রচুর পরিমাণে জমা হয়, তখন সেটা ব্লাডস্ট্রিম থেকে ফলিকলের পুষ্টিগ্রহণকে বাধাগ্রস্ত করে। এর দরুন ফলিকলের আকার ছোট হয়ে আসে এবং চুলের আকৃতিও চিকন হতে হতে হতে অবশেষে ওঠাই বন্ধ করে দেয়। DHT জিনিসটা আবার তৈরি হয় ৫-আলফা রিডাক্টেজ এনজাইমের সঙ্গে টেস্টস্টেরোন হরমোনের বিক্রিয়া থেকে। ইন্টারে বায়োলজি পড়ে আসা মাত্রই জানে এ হরমোনটাই একটা মানুষকে নারী থেকে পুরুষে রূপান্তরিত করে।* শুধু রূপান্তর করেই ক্ষান্ত হয় না, আমাদের পুরুষালি সব বৈশিষ্ট্যের পেছনে মূলত এ হরমোনটিই কলকাঠি নাড়ে। তো, যাদের ক্ষেত্রে টেস্টস্টেরোন প্রোডাকশন বেশি, স্বভাবতই বাই প্রোডাক্ট হিসেবে তাদের DHT প্রোডাকশনও বেশি। সে যাই হোক, নিজেকে যেহেতু বেশি ম্যাসক্যুলিন দাবী করতে যাচ্ছি না, তাই আপাতত এখানেই ক্ষ্যামা। তবে এ নিষ্ঠুর ধরণীকে শুধু এটুকু জানিয়ে যেতে চাই – টেস্টস্টেরোন আমাকে রেখেছে পুরুষ করে, মহান করেনি! 😥

শেষ করছি খুব রিসেন্ট একটা গবেষণার ফলাফল দিয়ে। সম্প্রতি Physiology and Behaviour নামের প্রসিদ্ধ একটা পিয়ার-রিভিউড জার্নালে একটা পেপার পাবলিশ্ড হয়েছে। সেখানে দাবি করা হয়েছে যাদের টেস্টস্টেরোন লেভেল হাই, তারা বেশি ঝাল খেতে পারে। ১৮-৪৪ বছর বয়েসী ১১৪ জন পুরুষকে বলা হয়েছিলো আলু ভর্তায় তাদের পছন্দ অনুযায়ী ঝাল পেপার সস এবং লবণ মাখিয়ে খেতে। দেখা গেছে যারা বেশি সস মিশিয়ে খেয়েছে, তাদের টেস্টস্টেরোন লেভেল অন্যদের চেয়ে বেশি। লবণের ক্ষেত্রে অবশ্য এমন কোন সংশ্লিষ্টতা (positive correlation) পাওয়া যায় নি। মনে পড়ে খুব ছোটবেলায় একটা ভারতীয় বাংলা ছবি দেখেছিলাম, সেখানে একটা বাচ্চা ছেলের মা দরজা আটকে ছেলেটির এক আঙ্কেলের সঙ্গে রুমে কিছু একটা করছে (তখন বুঝিনি কী হচ্ছিলো)। বাচ্চাটা রুমের দরজায় কিছুক্ষণ টোকাটুকি করে সারা না পেয়ে বাইরে গিয়ে দেখলো বাসার মালি বসে ভাত খেতে খেতে একটা কাঁচা লংকায় কামড় বসাচ্ছে। বাচ্চাটা জিজ্ঞেস করলো, “ঝাল লাগে না?” মালির জবাব, “ঝাল লাগে, মজাও লাগে।” দরজা আটকে মা এবং আংকেলের লীলাখেলার মতো মালির এ জবাবটিও আমার মাথা থেকে পঞ্চাশ হাত উপর দিয়ে গিয়েছিলো। বয়ঃসন্ধিকাল পার হবার সঙ্গে সঙ্গে আমার খাওয়ার রুচিতেও একটা পরিবর্তন এসেছে। ছোটবেলা আমি একটুও ঝাল খেতে পারতাম না, কিন্তু এখন ঝাল না খেলে খাবারে স্বাদ পাই না! ঝাল খেয়ে ওই মালি কী মজা পেয়েছিলো সেটা এখন আঁচ করতে আমার কষ্ট হয় না। আর মেয়েরা কেন বেশি ঝাল খেতে পারে না সেটিও এখন সহজেই অনুমেয়।
ফুটনোট
* আমরা সবাই ভ্রূণাবস্থায় মেয়ে হয়েই জন্মাই। গর্ভাবস্থার একটা পর্যায়ে গিয়ে যখন টেস্টস্টেরোন হরমোন তৈরি শুরু হয়, তখন সেই মেয়েরা ছেলে হয়ে ওঠে। এরপরও অবশ্য মেয়েদের দুগ্ধগ্রন্থি এবং নিপলটা রয়ে যায় ছেলেদের দেহে। শরীরে যথেষ্ট পরিমাণ প্রোল্যাক্টিন হরমোন প্রবেশ করালে ছেলেদের বুকেও দুধ তৈরি হতে পারে। এ নিয়ে আগের একটা লেখায় কিঞ্চিত আলোকপাত করেছিলাম।
Leave a comment