মুমিন-কথন

সতর্কীকরণঃ ধর্ম ও নবীরাসুল নিয়ে নাস্তিকদের বলা আজেবাজে কথা আছে লেখায়। তাই ধর্মীয় বিষয়ে সংবেদনশীলদের লেখাটি পড়তে নিরুৎসাহিত করছি। লেখা পড়ে পাঠকের ধর্মানুভূতি আহত হলে তার দায় কোনক্রমেই লেখকের নয়।

বহুদিন পর জীবনের অনেকগুলো সময় কালকে নষ্ট করলাম কিছু মুমিনের সঙ্গে হুদা তর্ক করে। বিষয়টা ছিল নবী মুহাম্মাদের (সাঃ) সমালোচনা করা যাবে কি যাবে না, তা নিয়ে। তো, যেটা দেখলাম, মুমিনদের সবচেয়ে বড় আপত্তির জায়গাটা হচ্ছে নবীর অবমাননা। যেটুকু বুঝলাম, কারো সমালোচনা করা মানে তাকে অপমান করা। হুম্‌ম্‌, ভাবনার বিষয়। এই একবিংশ শতাব্দীর সুশীল সভ্য বাংলাদেশে বসে আমরা এরকম আর কী কী জিনিসের অপমান-অবমাননা করে থাকি তা নিয়েই ভাবতে বসে গেলাম।

প্রতিদিন পত্রিকা খুললেই প্রথমে যেটা চোখে পড়ে সেটা হলো কোন না কোন রাজনৈতিক দল ও তার নেতানেত্রী, চোর, ডাকাত, খুনি, ধর্ষক, দুর্নীতিবাজদের নিয়ে নানান কেচ্ছাকাহিনী। এটাকে অবশ্য খবরের চেয়ে বেশি কিছু বলা যাবে না, মূল সমালোচনাটা থাকে প্রধানত সম্পাদকীয়তেই। মুমিনদের যুক্তি মানতে গেলে বলতে হয়, কলামিস্টরা সেখানে যাচ্ছেতাইভাবে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও তার নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গকে প্রতিদিন অপমান-অবমাননা করে যাচ্ছেন।

ব্যঙ্গ-বিদ্রুপেও মুমিনদের প্রবল আপত্তি। অথচ প্রায় প্রতিদিনই পত্রপত্রিকায় নানা রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গের কার্টুন প্রকাশিত হচ্ছে, সপ্তাহান্তে ম্যাগাজিনে লেখা হচ্ছে রম্যরচনা। মুমিনদের যুক্তিতে এসব অবমাননা নয় কি? মনে আছে সাবেক মন্ত্রী আবুল হোসেনের একটা কার্টুন ছেপেছিল প্রথম আলো, তা দেখে ভদ্রলোকের অনুভূতি আহত হয়েছিল খুব। এটা নিয়ে তিনি বিবৃতিও দিয়েছিলেন। তার এ আহত অনুভূতি নিয়ে সেবার আমাদের সুশীল শান্তিকামী মুমিনদের কিছু যায়-আসে নি।

পত্রপত্রিকায় সাংবাদিক, কলামিস্টদের এহেন ন্যক্কারজনক নোংরামি, অসভ্যতা দেখে অতিষ্ঠ হয়ে যে ফেসবুকে বসবো দুদণ্ড শান্তি পেতে তার-ও উপায় নেই। ট্রোল ফুটবল, ট্রোল ক্রিকেট, ট্রোল অমুক, ট্রোল তমুক ইত্যাদি নানা পেজে সয়লাব হয়ে আছে সেখানে। এই দল তো ঐ খেলোয়াড়, এই রাজনীতিক তো ঐ চলচ্চিত্র অভিনেতা – কী নেই যা নিয়ে রঙ্গরসিকতা হচ্ছে না? ব্যাপারখানা এমন যেন ঐ খেলোয়াড়, দল বা অভিনেতার কিংবা তাদের ফ্যান-সমর্থকদের কোন অনুভূতি নেই।

এ পর্যায়ে এসে মুমিনরা হয়ত বলবেন, “সবই বুঝলাম বাপু, কিন্তু আমার নবীকে নিয়ে কোন চুদুরবুদুর চইলত ন।” এখানেই বাধে বিপত্তি। এতে সন্দেহ নেই যে নিজ ধর্ম ও নবী-রাসুলদের প্রতি মানুষের শ্রদ্ধা অপরিসীম। নিজের জীবন উৎসর্গ করতে লোকে রাজি, তবু ধর্ম ও তার প্রবর্তকদের ব্যাপারে কোন কটুকথা সওয়া চলবে না। কথা হচ্ছে, আপনি আপনার ধর্মকে যতই সর্বশ্রেষ্ঠ ভাবেন, আপনার নবীকে যতই মহামানব বলে বিশ্বাস করেন, অন্য ধর্মাবলম্বীদেরকেও সেটা মানতে হবে কেন? আপনি যেটা সম্মান করেন, সম্মান পাবার বিন্দুমাত্র যোগ্যতা নেই জানা সত্ত্বেও তাকে সম্মান করতে ধর্মহীনদের কী ঠ্যাকা পড়েছে? আপনার ধর্মকে, ধর্মের প্রবর্তককে শ্রদ্ধা করতে হবে – মামাবাড়ির আবদার নাকি দাদা? আপনার ধর্মে যাদের বিশ্বাস নেই, কোন যুক্তিতে আপনার রাসুলকে তাদের সম্মান করতে বলেন? ইউনিভার্সিটিতে ভর্তির পর দেখেছি, কিছু তথাকথিত বড়ভাই তাদের ‘সম্মান’ নিয়ে খুবই চিন্তিত। ভর্তি হওয়া নতুন ছাত্রটি তাকে সম্মান করছে কিনা তা নিয়ে তাদের চিন্তার অন্ত নেই। সম্মান পাবার প্রথম পদক্ষেপটা নেয় তারা ‘র‍্যাগিং’ নামের একটা রিচুয়ালের মধ্য দিয়ে। নতুন ভর্তি হওয়া ছাত্রটিকে সেখানে কী কী ভাবে অপদস্থ করা হয় সে ব্যাপারে আর না-ই বলি। এরপর থেকে ছেলেটি বড় ভাইদেরকে যথাযথ সম্মান দিতে এতটুকু বাদ রাখবে না, এমন একটা নিশ্চয়তা নিয়েই যেন ছেলেটিকে সেখান থেকে ছাড়া হয়। ওদের সম্ভবত ধারণা নেই যে শ্রদ্ধা এমনি এমনি অর্জন করা যায় না, কারো শ্রদ্ধা পেতে গেলে আগে নিজেকে তা পাবার যোগ্যতা অর্জন করতে হয়। এদেশের অধিকাংশ ধর্মানুরাগীর মানসিকতাও তথৈবচ। তাদের জানা নেই যে একজন অবিশ্বাসীর কাছ থেকে যথার্থ সম্মান পেতে হলে তার ধর্মটিরও সেরূপ যোগ্যতা অর্জন করা চাই। কেবল গলা ও গায়ের জোরেই শর্টকাটে সম্মান আদায় করতে চায় এরা।

এবারে হয়ত বলবেন, “সম্মান না করুক, অন্তত তাকে নিয়ে বাজে কিছু বলা চলবে না।” আমার প্রশ্ন হচ্ছে, বিনা কারণে আপনি কাউকে অসম্মান করেন? যদি কোন কারণ থেকে থাকে, আপনি কি সেটা না বলে মুখ বুজে থাকেন? থাকেন না? তাহলে নাস্তিক বা অন্য ধর্মাবলম্বীদের সেটা বলতে বাধা কোথায়? হ্যাঁ, এতে আপনার অনুভূতি আহত হয় সেটা জানি, আপনি যখন কারো নিন্দা করেন, তখন তারও হয়, তার আত্মীয়, শুভাকাঙ্ক্ষী নিকটজনদেরও হয়। তাই বলে সত্য বলা থেকে বিরত থাকতে হবে?

স্পেডকে স্পেড বলার স্বাধীনতাই হচ্ছে বাকস্বাধীনতা। আপনি বাকস্বাধীনতায় বিশ্বাসী হয়ে থাকলে বলুন, ছয়বছরের বাচ্চার প্রতি যে লুলায়িত হয় সে কি শিশুকামী নয়? (দেখুন সহিহ বুখারি, খণ্ড ৫, বই ৫৪, হাদিস নং ২৩৪ এবং ২৩৬) দাসীর সঙ্গে সেক্স কিংবা একের পর এক বিয়ে করা কি বেহায়া সেক্স ম্যানিয়াক লুইচ্চার কর্ম নয়? (দেখুন, কোরআন, ৪:২৪, ৮:৬৯, ২৩:৫-৬ ইত্যাদি) নিজের পালিত পুত্রের স্ত্রীর দিকে যে নজর দেয়, বিয়ে করে, সে পার্ভার্ট বৈ আর কী? (কোরআন ৩৩:৪, ৩৩:৩৭, ৩৩:৪০) একের পর এক আক্রমণাত্মক যুদ্ধ, লুটপাট, যুদ্ধবন্দী নারী ও শিশুদেরকে দাসদাসী বানানো, যৌননির্যাতন, এগুলোর নির্দেশদাতাকে কী বলে? (কোরআন ৯:১-৬,১১,১২,১৪,১৫, ৩৩:৫০ ইত্যাদি) বউ পেটানো জায়েজ করে যে বাণী আউড়াতে পারে, তাকে নারীনির্যাতনকারী বলা কি দোষের কিছু? (কোরআন ৪:৩৪) যাদুটোনায় বিশ্বাসী বিজ্ঞানবিমুখ প্রাগৈতিহাসিক গণ্ডমূর্খকে সম্মানজনক কী বিশেষনে বিশেষিত করা যেতে পারে বলবেন কি? (কোরান ২:১০২, ৭:১১৬ কিংবা ১১৩:৪) কথায় কথায় যে নিজের বক্তব্য সৃষ্টিকর্তার নামে চালিয়ে দেয়, একজন ডাহা মিথ্যাবাদীর চাইতে সে কোন অংশে কম নির্দোষ নাস্তিকেরা জানতে চায়। মুমিনদের বহুল উচ্চারিত যে অভিযোগ – নাস্তিকেরা নবীকে গালিগালাজ করে, এর জবাব নিশ্চয়ই পেয়ে গেছেন এতক্ষণে।

পৃথিবীতে বহু মানুষ আছে এখনো যারা বিশ্বাস করে পৃথিবী সমতল, চাঁদ হচ্ছে পনিরের তৈরি, ভূত, ভ্যাম্পায়ার, ওয়ারউলফ ইত্যাদি বাস্তবেই আছে। আছে টেলিপ্যাথি, জ্যোতিষশাস্ত্র, ডাইনিবিদ্যা, প্ল্যানচেট, পুনর্জন্মের মতো বিশ্বাস। এযুগের নতুন গজানো বিশ্বাসগুলোর মধ্যে আছে এলিয়েন অ্যাবডাকশন, ভ্যাক্সিন নিলে শিশুর প্রতিবন্ধী হয়ে যাওয়া ইত্যাদি। এরকম আরও অসংখ্য বিশ্বাস-কুসংষ্কার আছে পৃথিবীতে যার সবকয়টা লিখে শেষ করা যাবে না। বৈজ্ঞানিক বাস্তবতার নিরিখে দেখলে এ বিশ্বাসগুলো হাস্যকর। হাসির উদ্রেক করে এমন কিছু নিয়ে হাসিঠাট্টা, ব্যাঙ্গবিদ্রূপের সুযোগ লোকে হেলায় হারাতে চায় না। এজন্যই এগুলো নিয়ে প্রতিনিয়ত কার্টুন আঁকা হয়, কৌতুক ও রম্য রচনা লেখা হয়। ঠিক একই কারণে ছয় দিনে পৃথিবী তৈরি ও এর বয়স ছয় হাজার বছর, নূহের প্লাবন, আদম-হাওয়ার কিচ্ছা, ভার্জিন বার্থ, মৃতকে জীবিত করা, পানির উপর দিয়ে হেঁটে যাওয়া, আত্মা, জিন, শয়তান, যাদুটোনা, তুকতাক, মিরাকলের জগাখিচুরিসহ অসংখ্য মিথ্যার উপরে প্রতিষ্ঠিত ধর্ম এবং সর্বোপরি সৃষ্টিকর্তার মতো কাল্পনিক চরিত্রে আপনার যে বিশ্বাস, বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে সেটাও অবিশ্বাসীদের কাছে হাস্যকর। সুতরাং, এটা নিয়ে একটু মকিং তো তারা করতেই পারে, কী বলেন? তাই বলি, বিশ্বাস নিয়ে হাসাহাসি অপছন্দ হয়ে থাকলে হাস্যকর কিছুতে বিশ্বাস না করলেই পারেন।

একজন অবিশ্বাসীর কাছে মুহাম্মাদ (সাঃ) একজন সাধারণ মানুষের চেয়ে বেশি কিছু নন। একজন অবিশ্বাসীর দৃষ্টিতে একাধারে তিনি একজন স্নেহময়ী পিতা, প্রেমিক, স্বামী, ক্ষেত্রবিশেষে দয়ালু, অন্যদিকে ক্ষমতার লোভে মত্ত, হিংস্র, শেষ বয়সে গিয়ে চারিত্রিক স্খলন ঘটা একজন ভণ্ড। আপনি পারেন না তার প্রতি আপনার অন্ধ ভক্তিকে অবিশ্বাসীদের উপর চাপিয়ে দিতে। একইভাবে আপনি পারেন না আপনার মহানবীর হাস্যকর কার্যকলাপ নিয়ে অবিশ্বাসীদের ব্যাঙ্গবিদ্রূপকে জোর খাটিয়ে বন্ধ করতে। সারাদিন ট্রোল পোস্টে লাইক দিবেন, শেয়ার করবেন, আর দিনশেষে বলবেন, “খুনখারাবি আমার পছন্দ না, তবে আমার প্রফেটকে ইনছাল্ট করাও ঠিক না”, তখন আপনার এ চরিত্রকে বিশেষিত করবার জন্য খাঁটি বাংলায় একটা চমৎকার শব্দ বরাদ্দ আছে – দ্বিচারিতা, ইংরেজিতে যাকে বলে Double Standard নীতি।

==========================================

আমার গর্দানে কোপ দেয়ার জন্য এতক্ষণ যথেষ্ট উপকরণ সাপ্লাই দিলাম আপনাদের। জানের মায়া কার না থাকে? এজন্যই বলে রাখি, লেখার কোথাও কিন্তু আমি বলি নি আমি নাস্তিক, ইসলামবিদ্বেষী, আমি আপনার ধর্ম নিয়ে এমনটা ভাবি, অমনটা মনে করি। ভালো করে পড়ে থাকলে দেখবেন সবখানেই বলেছি নাস্তিকেরা/অবিশ্বাসীরা আপনার ধর্ম নিয়ে কী ভাবে, তাদের দৃষ্টিভঙ্গি কী, যুক্তিগুলো কী। নাস্তিকদের লেখালেখি আপনার চেয়ে বেশি পড়েছি এবং এসব নিয়ে ভেবেছি বলেই আমি এটা জানি। আপনার মতো আমারও ধারণা নাস্তিকেরা ভুল, তাদের যুক্তিতে গলদ আছে। কিন্তু কেবল ধারণা করলেই তো তা সত্যি হয়ে যায় না, প্রমাণও লাগে। তাই সে ভুলগুলো কোথায় আমি জানতে চাই। আমি যেহেতু পারছি না বের করতে, আপনারা হেল্প করেন আমাকে। এই ফাঁকে কানে কানে একটা কথা বলে রাখি, নাস্তিকদের লেখার জবাবে তাদের কল্লা কেটে ফেললে আমার বিশ্বাস নড়ে ওঠে। বেপারটা একটু ভেবে দেখবেন।

Leave a comment