সমকামিতা নিয়ে জনগণের কান্নাকাটি এখনো থামেনি দেখছি। ট্রোল পোস্ট থেকে শুরু করে লাইকজীবী ছাগস্বামী সেলেব্রিটি ফেসবুকারের স্ট্যাটাস ও তাতে ছাগসম্প্রদায়ের ম্যাৎকার এখনো পুরোমাত্রায় চলছে। আবার উল্টোটাও ঘটছে, বিভিন্ন সময় জনগণকে জ্ঞান দান করে স্ট্যাটাস প্রসব করা সেলেব্রিটিরা এরকম সেন্সেটিভ বিষয়ে জনগণকে সত্যটা জানানোর ব্যাপারে একেবারেই স্পিকটি নট হয়ে আছেন। যারা হাউকাউ করছে, তাদের বক্তব্যে দেখলাম কয়েকটা বিষয়ই ঘুরেফিরে আসছে। প্রশ্নোত্তর আকারে ওগুলোর জবাব লিখে ফেলার চিন্তা থেকেই এই পোস্ট। সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র ভাবনা, পড়ে যদি মনে হয় কোথাও ভুল বলেছি, জানাবেন আশা করি। গঠনমূলক সমালোচনা সাদরে গৃহীত। 🙂
সমকামিতা প্রকৃতিবিরুদ্ধ।
প্রকৃতিবিরুদ্ধ মানে কী? যেটা প্রকৃতিতে পাওয়া যায় না? তাহলে এ লিঙ্কটি ফলো করে দেখে নিন মানুষের বাইরে প্রকৃতিতে আর কোন কোন প্রজাতিতে সমকামের নজির পাওয়া যায়ঃ https://en.wikipedia.org/wiki/List_of_animals_displaying_homosexual_behavior। ২০০৬ সালের এক হিসেবে প্রায় ১৫০০ প্রজাতির জীবে সমকামিতার অস্তিত্ব দেখতে পাওয়া যায়।[১] এবার বলুন, সমকামিতাকে কি প্রাকৃতিক বলা যায়?
কিন্তু প্রকৃতি নারী-পুরুষ সৃষ্টি করেছে একে অপরের প্রতি আকৃষ্ট হবার জন্য, সমলিঙ্গের প্রতি নয়।
প্রকৃতি নিয়ে আরেকটু জানাশোনা থাকলে বুঝতেন যে প্রকৃতি কোন বুদ্ধিমান সত্ত্বা না। এর কোন মস্তিষ্ক নেই, চিন্তা করার ক্ষমতা নেই, স্বভাবতই কোন উদ্দেশ্যও নেই। কোন উদ্দেশ্য নিয়ে প্রকৃতি নারী-পুরুষ তৈরি করে নি। বিবর্তনের পরিক্রমায় প্রায় ১২০ কোটি বছর আগে বিশেষ কিছু কন্ডিশনে যখন সেক্সুয়াল রিপ্রডাকশন অ্যাসেক্সুয়াল রিপ্রডাকশনের চেয়ে বাড়তি সিলেক্টিভ অ্যাডভান্টেজ পেয়েছিলো, ঠিক তখন প্রথমবারের মতো সেক্সুয়াল অর্গানিজমের উদ্ভব হয়। এরপর বিভিন্ন সময় অনেক জীবই আবার অ্যাসেক্সুয়াল পদ্ধতিতে ফিরে গেছে। উদ্ভিদের মধ্যে আমরা এরকম দুই ধরনের রিপ্রডাকশন পদ্ধতিই দেখতে পাই। প্রাণীদের মধ্যেও অ্যাসেক্সুয়াল রিপ্রডাকশন দেখা যায়, যেমন হুইপ্টেইল লিজার্ড কিংবা এরকম আরোঃ https://en.wikipedia.org/wiki/Parthenogenesis ।
নূহের নৌকায় প্রতিটি প্রজাতির প্রাণী থেকে নারী-পুরুষ দুইটি করে উঠলেও প্রকৃতিতে দেখা যায় অনেক প্রজাতিতেই লিঙ্গ আছে দুইয়ের বেশি। যেমন, এই গরগিটিগুলোকে দেখুন, ওদের মধ্যে লিঙ্গ আছে পাঁচ পাঁচটিঃ https://en.wikipedia.org/wiki/Side-blotched_lizard। আমরা প্রধানত দুই লিঙ্গবিশিষ্ট প্রজাতিদের থেকে বিবর্তিত। বিবর্তনের মাধ্যমেই আমাদের মস্তিষ্ক এমনভাবে hard-wired হয়েছে যাতে আমরা বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকৃষ্ট হই। মস্তিষ্কের এরকম বৈশিষ্ট্যের পেছনে কলকাঠি নাড়ে আমাদের ডিএনএ। বিভিন্ন জিনের পারষ্পরিক মিথষ্ক্রিয়ায় আমাদের মস্তিষ্ক ঠিক করে আমরা কার প্রতি আকৃষ্ট হবো আর কার প্রতি হবো না।
প্রাকৃতিকভাবেই আমাদের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যে পার্থক্য থাকে। এ পার্থক্যটা হয় জিনের ভ্যারিয়েশনের কারণে। এ ভ্যারিয়েশন তৈরি হয় মিউটেশনের মাধ্যমে। প্রকৃতি যেহেতু মস্তিষ্কবিহীন নিরেট গর্দভ এবং একে নিয়ন্ত্রণ করার জন্যও বুদ্ধিমান কেউ নেই, তাই স্বাভাবিকভাবেই প্রকৃতিতে এ ভ্যারিয়েশনগুলো তৈরি হয়। এ ব্যাপারে আর সবিস্তারে লিখতে চাচ্ছি না, কারো ইচ্ছে হলে আগের এ লেখাটি পড়ে দেখতে পারেন।
মন, কনশাসনেস ইত্যাদি জিনিসকে আমরা যেভাবে আত্মা বা এ টাইপের কোন অতিপ্রাকৃতিক সত্ত্বার কাবজাব বলে মনে করি, আসলে তা নয়। আমাদের সমস্ত চিন্তাভাবনার উৎস হচ্ছে মস্তিষ্ক যেটা আবার কাজ করে বিভিন্ন হরমোন ও অন্যান্য রাসায়নিকের ক্রিয়া-বিক্রিয়ায়। এগুলোও যেহেতু জিনের অভিব্যক্তির ফল, তাই এসবের ভ্যারিয়েশনে আমাদের বৌদ্ধিক আচার-আচরণেও ভিন্নতা দেখা যায়। ঠিক একারণেই সবার চরিত্র, মানসিকতা বা পছন্দ-অপছন্দ ইত্যাদি কখনো পুরোপুরি মেলে না। এর সঙ্গে শিক্ষাদীক্ষা, ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা ইত্যাদি আরো নানারকম পারিপার্শ্বিক প্রভাব যুক্ত হয়ে এ পার্থক্যকে আরও বড় করে তোলে। মোদ্দা কথা হলো, আমাদের যেকোনরকম শারীরিক-মানসিক বৈশিষ্ট্যের প্রকরণই হচ্ছে প্রকৃতিজাত। এখানে অতিপ্রাকৃতিক কোন এজেন্টের কিরিঞ্চি নাই।
তো, এই ভ্যারিয়েশন এবং তার উপর চলা ন্যাচারাল সিলেকশনের মাধ্যমেই কোটি কোটি প্রজন্ম ধরে বিবর্তিত হয়ে আজ আমরা এই দুই লিঙ্গের প্রজাতিতে এসে পৌঁছেছি। স্বাভাবিকভাবেই বিবর্তনের মাধ্যমে আমরা নারী-পুরুষেরা আমাদের দেহে স্ব স্ব রিপ্রডাক্টিভ অ্যাপারেটাস পাওয়ার সাথে সাথে এগুলোকে ব্যবহার করার জন্য যে বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকর্ষণ দরকার হয়, সেটাও পেয়েছি। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, সবকিছুর ভ্যারিয়েশনের মতো এই আকর্ষণ বোধেও ভ্যারিয়েশন থাকে। বেশিরভাগই বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকৃষ্ট হলেও কেউ কেউ হয় সমলিঙ্গের প্রতি। অর্থাৎ, প্রকৃতি আমাদেরকে সন্তান জন্মদানের উপযোগী নারী-পুরুষরূপে তৈরি করা সত্ত্বেও নেহাত মিসফায়ারবশত কাউকে কাউকে অনিচ্ছুকরূপে তৈরি করে থাকে। এরকম আরো কিছু মিসফায়ারের ফসল আমরা প্রত্যেকেই বয়ে বেড়াচ্ছি। আপনি ছেলে হয়ে থাকলে একবার নিজের দিকে তাকিয়ে বলুন আপনার স্তনবৃন্ত কী কাজে আসছে।
কিন্তু রিসার্চে প্রমাণিত হয়েছে সমকামিতা জেনেটিক নয়।
ভুল। গবেষকেরা চেষ্টা করেছিলেন সমকামিতার জন্য কোন জিন দায়ী কিনা খুঁজে দেখতে। দেখা গেছে, চোখের আইরিস বা চুলের রঙের মতো ‘গে জিন’-কে যতটা সোজাসাপ্টা মনে করা হয়েছিল, আসলে তা নয়। আইডেন্টিক্যাল টুইনদের মধ্যে পরিচালিত বেশ কিছু গবেষণায় দেখা গেছে যেখানে দু’জনেরই সমকামী হবার কথা, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সেরকম হচ্ছে না। এর থেকে আসলে এটা প্রমাণিত হয় না যে সমকামিতার জন্য কোন জিন দায়ী নয়। এপিজেনেটিক্সের গবেষণা থেকে আমরা জানি পরিবেশগত প্রভাবকের উপস্থিতিতে বিভিন্ন জিনের এক্সপ্রেশন কীভাবে বদলে যেতে পারে। আইডেন্টক্যাল টুইনরা জেনেটিক্যালি ১০০% এক হওয়া সত্ত্বেও বিভিন্ন কারণে তাদের জিনগুলো একইভাবে এক্সপ্রেস করে না সবসময়। বিভিন্ন প্লায়োট্রপিক জিনের এক্সপ্রেশনের উপর নির্ভর করে অন্য আরো অনেক জিন কীভাবে আচরণ করবে। এগুলোর একটিতে এপিজেনেটিক পরিবর্তন ঘটলে অন্য অনেক বৈশিষ্ট্যে পার্থক্য তৈরি হতে পারে। আইডেন্টিক্যাল টুইনদের সমকামিতার ক্ষেত্রেও এরকম কিছু ঘটার যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে।
সমকামিতার কারণ হিসেবে ইতোমধ্যেই বেশ কিছু জেনেটিক মার্কার খুঁজে পেয়েছেন গবেষকেরা।[২] কিন্তু এ নিয়ে শেষ কথা বলে দেবার সময় এখনো আসে নি। এখনো অনেক গবেষণা চলছে এ নিয়ে, হয়ত ভবিষ্যতেও চলবে। কিন্তু এটা অস্বীকার করার উপায় নেই যে অন্যান্য সব প্রাণী প্রজাতির মতো মানুষের মাঝেও সমকামিতার অস্তিত্ব বিদ্যমান। সমকামিতা একটা brute fact, এর ব্যাখ্যাটাই কেবল অজানা।
বুঝলাম, কিন্তু সেক্স তো কেবল সন্তান জন্মদানের জন্যই। শিশ্নের সঠিক স্থান হলো যোনি। পায়ুকামকে কোনভাবেই প্রাকৃতিক বলা যায় না, এটা বিকৃতি।
এ ধরণের ফ্যালেইশাস আর্গুমেন্টকে বলা হয় appeal to nature। প্রাকৃতিক না হলেই কোন কিছু বিকৃত হয়ে যায় না। তা-ই যদি হয়, তাহলে হস্তমৈথুন বা স্বপ্নদোষও বিকৃতি। চুল-দাড়ি কামানো বা যৌনকেশ শেভ করাও তাহলে বিকৃত কাজ। খৎনা করাও বিকৃতি। সেক্সের উদ্দেশ্য কেবল সন্তান জন্মদান হয়ে থাকলে কনডম বা অন্য কোন কন্ট্রাসেপ্টিভ মেথড ব্যবহার করাও মানসিক বিকৃতি। অসুখ হলে চিকিৎসা করা, ভ্যাক্সিন নেয়া, গাড়িতে চড়া, সিনেমা দেখা, ফ্যানের বাতাস খাওয়া, ফেসবুকিং করা, এমনকি কাপড়চোপড় পড়াও বিকৃত রুচির পরিচায়ক। লিস্ট বড় হয়ে যাচ্ছে? এর চেয়ে বরং আমরা সারাদিনে প্রাকৃতিক কোন কাজগুলো করি তার লিস্ট করুন, এক পেইজেই এঁটে যাবার কথা।
সমকামিতা একটা মানসিক রোগ।
আর সব ব্যাপারে পণ্ডিতি করেন ঠিক আছে, অন্তত ক্যানভাসারের লিফলেট পড়া জ্ঞানে চিকিৎসাবিজ্ঞান কপচাতে আসবেন না। রোগ নির্ণয়ের জন্য মেডিক্যালে পড়ে আসা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত চিকিৎসকেরা আছেন, তাদের মতামত নিন, নিজে রোগ ডায়াগনোজ করতে যাবেন না কখনো। এ উপদেশটুকু মাথায় রাখুন, হিতে আপনারই উপকার হবে।
একসময় রাম-শ্যাম-যদু-মধু থেকে শুরু করে মনোবিজ্ঞানীরা পর্যন্ত সমকামিতাকে রোগ বলেই মনে করতেন। এর চিকিৎসায় লবটমি, কেমিক্যাল ক্যাস্ট্রেশন, ইলেক্ট্রিক শকের মতো নানারকম যন্ত্রণাদায়ক কনভার্শন থেরাপির পরে যখন দেখা গেলো সমকামীকে কোনভাবেই বিষমকামীতে রূপান্তর করা যাচ্ছে না, তখন হাল ছেড়ে দিতে বাধ্য হয় একসময়। এটা এখন একটা সায়ান্টিফিক কনসেন্সাস যে, সমকামীকে বিষমকামীতে রূপান্তর করা অসম্ভব।[৩]
অনেক রোগই তো থাকে অনিরাময়যোগ্য, এটাও কি তাহলে অমন কিছু? মোটেও না। রোগ নির্ণয়ের ক্রাইটেরিয়াগুলোর সঙ্গে সাংঘর্ষিক হওয়ায় এ লাইনে কাজ করা গবেষকদের সম্মতিক্রমে বিশ্বের সব বড় বড় স্বাস্থ্য সংস্থাই ঘোষণা করেছে যে সমকামিতা কোন মানসিক রোগ নয়। বিশ্বের সবচেয়ে নামজাদা সাইকোলজিস্টদের সংগঠন আমেরিকান সাইকোলজিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন ও আমেরিকান সাইকিয়াট্রিস্ট অ্যাসসিয়েশনের পর ১৯৯০ সালে ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশনও ঘোষণা করে যে সমকামিতা কোন রোগ নয়।[৪] কোন মানসিক কন্ডিশন যদি কারো ব্যক্তি বা কর্মজীবনের স্বাভাবিক কাজকর্মে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে, তাহলেই সেটিকে রোগ বলে চিহ্নিত করা হয়। রোগ চেনার আরেকটা সহজ উপায় হচ্ছে এটা কোন শারীরিক বা মানসিক যন্ত্রণার কারণ কিনা দেখা।[৫] সমকামিতার ক্ষেত্রে এমন কিছুই পরিলক্ষিত হয় না। সমকামীরা ব্যক্তি জীবনে যেমন সুখী, কর্মজীবনেও দারুন সফল। ওদের প্রতি সমাজের নির্মমতাই ওদের সুখী জীবনকে ব্যহত করে।
তবু সমলিঙ্গ বিবাহের আইনিকরণ সমর্থন করতে পারি না। এটা ধর্মে নিষেধ।
আপনার ধর্মে R-rated মুভি দেখা নিষেধ বলে কি সেটা সবারই মানা? আপনার ধর্মে প্রেম করা নিষেধ, তাহলে কি সরকারের উচিৎ ছেলে-মেয়ে প্রেম করাও বেয়াইনি করে দেয়া? আজকে মুভি দেখা বেয়াইনি করতে বলবেন, সেটা করলে কাল বলবেন প্রেম বেয়াইনি করতে। এভাবে আশকারা পেয়ে পেয়ে মাথায় উঠে এরপর হয়ত বলে বসবেন, ধর্মে মূর্তিপূজাও নিষেধ, অতএব…
ধর্মে নিষেধ থাকলে আপনার নিষেধাজ্ঞা নিয়ে আপনি বসে থাকুন, তা দিয়ে অন্যের ন্যয্য অধিকারকে ক্ষুণ্ন করার অপচেষ্টা চালাবেন না। ধর্ম যার যার, অধিকার সবার।
কথাপ্রসঙ্গে বলে রাখি, হারাম হলেই কিছু যেমন খারাপ হয়ে যায় না, হালাল হলেও তা সবসময় ভালো হয় না। যেমন ধরেন, ইসলামে বউ পেটানো হালাল, কিন্তু আইনে এটা অপরাধ।
তথ্যসূত্রঃ
২। http://www.newscientist.com/article/dn26572-largest-study-of-gay-brothers-homes-in-on-gay-genes.html#.VZPCUSoa69E
পুনশ্চঃ ইসলামকে টেনে আনায় আবার ইসলাম-বিদ্বেষী ট্যাগ দিয়ে বসবেন না যেন। যেকোন আলোচনা থেকে ধর্মকে দূরে রাখতে চাই সবসময়। এদেশীদের মধ্যে অন্য কোন ধর্মের লোককে সমকামিতার বিরোধিতায় ধর্মের কান টানতে দেখি নি। সমকামিতা নিয়ে আলোচনায় বিরোধী পক্ষ যেহেতু বার বার ইসলামকেই টেনে আনছে, তাই এটা নিয়ে কিছু বলাটাই সবচেয়ে প্রাসঙ্গিক মনে করেছি।
Leave a comment