সিরিয়াসনেস স্কেলে এই লেখার মান শূণ্য। তারপরও যদি কেউ অফেন্ডেড হন, তার দায় পাঠকের।
বেশ অনেকবছর ধরেই বডি-পজিটিভিটি মুভমেন্টটা দেখে আসছি। যাদের কাছে ব্যাপারটা নতুন, সহজ করে বললে, নিজের শরীর বা চেহারা যেমনই হোক, ইতিবাচকভাবে নিতে হবে। সমাজ, পপ কালচার, মিডিয়া, ইত্যাদি সৌন্দর্যের যে স্ট্যান্ডার্ড নির্ধারণ করে দিয়েছে, তাতে ভ্রূক্ষেপ করা চলবে না। কালো-ধলো, লম্বা-বেটে, মোটু-পাতলু, কিংবা টাক মাথা — যে যেমনই হোক, সবাই সুন্দর।
আমি নিজে টাকলু, সুতরাং এ দৃষ্টিভঙ্গিকে সমর্থন না করে উপায় নেই। কতদিন আর নায়কের মাথায় চুল আর ভিলেনের টাক দেখতে ভালো লাগে? কিন্তু গোল বাধে যখন দেখি বডি পজিটিভিটির নামে ভোগবাদিতাকে গ্লোরিফাই করা হচ্ছে।

আমার ব্যাপারে অনেকেরই অভিযোগ যে আমি নাকি body-shamer। এ ব্যাপারে আত্মপক্ষ সমর্থন করে সবসময় একটা কথাই বলি, আমি যেমন পাপীকে নয়, পাপকে ঘৃণা করি, কিংবা বিশ্বাসীকে নয়, অপবিশ্বাসকে ঘৃণা করি, ঠিক তেমনি মোটা মানুষকে নয়, মোটা হওয়ার প্রসেসকে ঘৃণা করি।
সামনে এগুনোর আগে আমি “মোটা” কাকে বলি সেটা একটু বলে নিই। এ ব্যাপারে বৈজ্ঞানিক কোন সংজ্ঞা আছে কিনা জানা নেই। যদ্দূর জানি, Body Mass Index (BMI) নামে একটা পদ্ধতিতে overweight এবং obesity নির্ধারণ করা হয়। “সুস্থ” হিশেবে নির্ধারিত রেঞ্জের বেশি হয়ে গেলে overweight, এবং সেই রেঞ্জ ছাড়িয়ে আরও বেড়ে গেলে obese বলে ধরে নেয়া হয়। কিন্তু এই BMI আসলে সবসময় সত্যি বলে না, কিন্তু সেটা অন্য টপিক। মূল প্রসঙ্গে থাকি।
আমার কাছে মোটা মানুষের সংজ্ঞা এরকম — যারা এসকেলেটরে একপাশে দাঁড়ালে অন্যপাশ দিয়ে হেঁটে ওঠা যায় না, লোকাল বাসে যাদের পাশে বসলে পশ্চাদ্দেশের অর্ধেকটা সিটের বাইরে ঝুলে থাকে, রিকশায় যাদের সঙ্গে উঠলে রিকশাওয়ালার সঙ্গে নিজেরও নাভিশ্বাস ওঠে, আগুন লাগা ভবনের সিঁড়ি ভেঙে নামার সময় যারা সামনে থাকলে পেছনে হাজার খানেক মানুষের মারা যাবার সম্ভাবনা কয়েকগুণ বেড়ে যায় (আমার হয়েছিলো), কিংবা লিফটে একজন উঠলে দুইজনকে নেমে যেতে হয়, মূলত এমন লোকেরাই আমার মতে মোটা।
তো যা বলছিলাম। মোটা মানুষকে ঘৃণা করা কাজের কথা না, কিন্তু প্রসেসটাকে ঘৃণা করাই যায়। তো সে প্রসেসটা কী? সোজা বাংলায় নিচের সমীকরণ:
ওজন বৃদ্ধি = ক্যালরি গ্রহণ – ক্যালরি খরচ
খরচের চেয়ে গ্রহণ বেশি হলে ওজন বাড়বে। উল্টোটা হলে কমবে। সমান হলে অপরিবর্তিত থাকবে। আর এ ক্যালরি আসে খাবার থেকে।
অর্থাৎ, সুস্থ-স্বাভাবিকভাবে বেঁচে থাকার জন্য আমার শরীরের যতটুকু খাবার দরকার, ততটুকুতে সন্তুষ্ট থাকলে ওজন বাড়বে না। কিন্তু আমরা কী করি? যতটুকু দরকার, তার থেকে অ-নে-ক বেশি খাই। সেই বাড়তিটা বিভিন্ন শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়ায় চর্বি হয়ে জমা হয় — দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর।
শর্করা জাতীয় খাবার অত্যন্ত শক্তিশালী নেশাদ্রব্য। খেলে ব্রেইন একটা ডোপামিন হিট পায়, ভালো লাগার অনুভূতি জাগে, আরো খেতে ইচ্ছে করে। দিনের পর দিন এমন চলতে থাকলে একটা সময় গিয়ে ওই ডোপামিনে আর কাজ হয় না, আরো লাগে। এরপর আরো। একে বলে নেশা। কফির ক্যাফেইন, সিগারেটের নিকোটিন বা অন্য যেকোন মাদকের অ্যাক্টিভ ইনগ্রেডিয়েন্টের সাথে এর তফাত নেই। হঠাৎ ছেড়ে দিলে হয় উইথড্রয়াল সিনড্রোম, ঠিকমতো খেতে না পেলে মন-মেজাজ বিগড়ে থাকে।
তেরো হাজার বছর আগ পর্যন্ত, প্রাক-কৃষিবিপ্লবের সময় সমীকরণের “ক্যালরি গ্রহণ” অংশটুকু ছিল অত্যন্ত কঠিন একটা কাজ। আর শর্করা সেই কঠিন কাজের সহজ সমাধান — খুব কম পরিমাণ শর্করাতেই প্রচুর পরিমাণ শক্তি। আর তাই আমাদের শিকারী-সংগ্রাহক পূর্বপুরুষেরা বিবর্তিত হয়েছে এমনভাবে যাতে শর্করার স্বাদ পেলে লোল ঝরে, খেতে মন চায়। আর তার তাগিদেই নিরন্তর ছুটে চলা। কিন্তু সময় বদলেছে, আমাদের চারপাশে এখন শর্করার ছড়াছড়ি। দামে কম, মানে খারাপ, কিন্তু স্বাদে শর্করার জুড়ি নেই। তেরো হাজার বছর আগেকার ওই শিকারী-সংগ্রাহকদেরই বংশধর আমরা, তাই ওদের জিনগুলো আমাদেরও আছে। শর্করার স্বাদ পেলে আমাদেরও একইভাবে লোল ঝরে।
এবার আসি খরচে। আলসেমি আমাদের জেনেটিক বৈশিষ্ট্য। তেরো হাজার বছর আগে অনেক শ্রমের পরে পাওয়া কিছু শর্করা থেকে আহৃত শক্তি যতটুকু সঞ্চয় করা যেতো ততই লাভ। তাই অপ্রয়োজনে কেউ শক্তি অপচয় করতো না। ওদের জিনগুলো বহন করি বলে আমরাও ঠ্যাকায় না পড়লে নড়তে চাই না। প্রযুক্তিতে উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের কায়িক শ্রমের প্রয়োজনীয়তা কমে আসছে। আগে বাইরে খেতে গেলেও সশরীরে রেস্তোরাঁয় যেতে হতো। এখন ফুডপান্ডা বা পাঠাও-এ অর্ডার দিলেই হলো, শুধু রিসিভ করে মুখে তুলে খাওয়াটাই যতটুকু কষ্ট।
তাহলে কী দেখতে পাচ্ছি? একদিকে যেমন আমরা খাচ্ছি বেশি, অন্যদিকে শক্তি খরচও করছি কম। পৃথিবীতে এখনো বিশাল একটা জনগোষ্ঠী ঠিকমতো খেতে পায় না, দেড় কোটি শিশু অপুষ্টিতে ভুগছে, এদের বড় একটা অংশ মারা যাচ্ছে অপুষ্টিজনিত রোগে। আর আমরা যারা privileged, খেয়ে খেয়ে ভুরি বাড়াচ্ছি। খ্রিশটীয় বিশ্বাসে সাতটা কবিরা গুনাহর মধ্যে Gluttony আর Soth দুইটা। আর এ দুইটাই দিনের পর দিন চলতে থাকলে ফলাফল মোটা হয়ে যাওয়া। মোটা হওয়া কোন পাপ না, পাপের ফল। মোটা হওয়ার প্রক্রিয়াকে পজিটিভলি নেয়ার কিছু নেই।
কিছু শারীরিক কন্ডিশন বা অসুস্থতার কারণে, কিংবা ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় মানুষ মোটা হয়ে যেতে পারে। কিন্তু নিজের চারপাশে একবার তাকান, তিরিশোর্ধদের অধিকাংশরই দেখবেন পেট মোটা। এতগুলো অসুস্থ মানুষ চারপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে — ব্যাপারটা ভাবলে নিজেকেই অসুস্থ মনে হয় আমার, বিশেষ করে মানসিকভাবে।
Leave a comment