সময় গেলে সাধন হবে না: প্রসঙ্গ মুসলমানদের বিবর্তনবাদ বিরোধিতা

ইসলামের সুন্নি মতাদর্শের সবচেয়ে প্রসিদ্ধ তাফসিরের একটা হচ্ছে তাফসিরে জালালাইন, লেখা হয় পনের শতকের মাঝামাঝি থেকে ষোল শতাব্দীর মধ্যে। সেখানে সুরা গাশিয়াহ-এর ১৭ থেকে ২০ নাম্বার আয়াতের ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে নিচের ছবির এ কথাগুলো। সূত্র বাংলা তর্জমার পাইরেটেড কপি। ইংরেজি অনুবাদ পাবেন এখানে

“আর ভূতলের দিকে কিরূপে তাকে সমতল করা হয়েছে? … سُطِحَتْ শব্দ দ্বারা বাহ্যত এটাই প্রমাণিত হয় যে, পৃথিবী সমতল। শরিয়তের আলিমগণের মতও এটাই, ভূতত্ত্ববিদদের মতানুরূপ গোলাকার নয়।” এখানে একটা ব্যাপার লক্ষ্যণীয় — মক্কার কাফিরদেরকে বলা হচ্ছে, আল্লাহর এসব কুদরত দেখেও কি তারা ঈমান আনবে না? অর্থাৎ, তখনকার মক্কাবাসীর ভুগোল জ্ঞানের সঙ্গে কোরআন রচয়িতাও একমত এবং এটাকেই তিনি দাবি করছেন বিশাল কুদরত বলে।

অথচ এর প্রায় দেড় হাজার বছর আগে গ্রিক জিনিয়াস এরাটস্থেনিস কেবল প্রমাণই করেননি যে পৃথিবী গোল, দুইটা লাঠি দিয়ে এর পরিধি পর্যন্ত প্রায় নির্ভুল বের করে ফেলেছিলেন।

দুই হাজার বছর পরে এসে এখনো কিছু মানুষ মনে করে পৃথিবী সমতল। বিশ্বায়ন আর বিজ্ঞানের প্রসার তো হলো এই সেদিন, এরাটস্থেনিসের পর আরব অঞ্চলের বিশাল জনগোষ্ঠী বহুদিন পর্যন্ত ভেবে এসেছে পৃথিবী সমতল। সেসময়কার গালগল্প ও পুরাণে এ সমতল পৃথিবীর ধারণার নজির পাওয়া যায়। যেমন ধরা যাক জুলকারনাইনের ভ্রমণকাহিনী, যিনি কিনা পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ভ্রমণ করেছিলেন — যেখানে সূর্য ওঠে, সেখান থেকে শুরু করে যেখানে অস্ত যায়, সেখানে পর্যন্ত। ধর্মগ্রন্থ লেখার আটশ বছর পরে এসেও দেখা যাচ্ছে তাফসিরকারকগণ সেই বিশ্বাসের বাইরে বেরোতে পারেননি। ব্যাপারটা এযুগের শিক্ষিত মুসলমানদের জন্য এখন একটা লজ্জার কারণই বটে।

ঠিক একইভাবে, অনেক বছর পরে মুসলমানদের গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়াবে হাল আমলের বিবর্তনবাদ বিরোধিতা। এখনকার সব লেখালেখি, বইপুস্তক, সংবাদ, ভিডিও, অডিও, কিংবা ফেসবুক পোস্ট হয়ত আরও অনেক বছর পরেও লোকে দেখতে পাবে। অশিক্ষা ও অজ্ঞতার কারণে অনেকেই এখন বুঝতে পারছেন না, শিক্ষা-দীক্ষায় একটু উন্নতি করলে পরে অনেকেই হয়ত এ বিরোধিতার কথা অস্বীকার করবে, কেউ কেউ মানব-সৃষ্টির ধর্মীয় গালগপ্পকে বলবে অপব্যাখ্যা, কেউ কেউ আরবি ভাষার নতুন তত্ত্ব নিয়ে হাজির হবে, কিন্তু দিন শেষে এটা নিশ্চিত, সত্য প্রতিষ্ঠিত হবেই। একে অস্বীকার করে জ্ঞান-বিজ্ঞানে অগ্রগতির আশা করা বোকামি, অন্তত এভোল্যুশনারি বায়োলজির যত শাখা আছে, সেসবে। এটা যত দ্রুত উপলব্ধি করবে লোকে, তত মঙ্গল।

সৌরকেন্দ্রিক মতবাদের বিরোধিতা করে খ্রিশটান চার্চ যে ভুল করেছিলো, যার কারণে অনেকেই নাস্তিকতার পথে হেঁটেছে, এমনকি এযুগে অধিকাংশ খ্রিশটানই বাইবেলের আক্ষরিক ব্যাখ্যায় অবিশ্বাসী, ঠিক একই কারণে ইসলাম অনেক অনুসারী হারাবে শুধুমাত্র বৈজ্ঞানিক সত্যকে অস্বীকার করার কারণে। বরাবরের মতোই ইসলামের সবচেয়ে বড় ক্ষতিটা কোন অমুসলিম বা নাস্তিকের হাতে হচ্ছে না, এর জন্য দায়ী মুসলমানেরা। এমনিতেই ইসলামোফোবিয়া থেকে শুরু করে নানারকম নেগেটিভ স্টেরিওটাইপিং-এ মুসলমানরা এখন সারা দুনিয়ায় শীর্ষে। ভবিষ্যৎ আরও অন্ধকার হবার আগেই একে ওকে গালাগাল দেয়া বাদ দিয়ে মুসলমানদের উচিৎ ইসলামি সৃষ্টিতত্ত্বের নতুন সংস্করণে হাত দেয়া।

পৃথিবীর আকার, কিংবা আকাশের প্রকার, ইত্যাদির ব্যাপারে এখনকার মুসলমানরা আক্ষরিক ব্যাখ্যায় যান না। কেউ মনে করে না পৃথিবী সমতল কিংবা আকাশকে খুঁটি ছাড়া ছাদের মতো দাঁড় করিয়ে রাখা যার থেকে একটা অংশ ভেঙে পড়লেই তুলকালাম (২১:৩২, ৩৪:৯)। কিন্তু গোল বাধে জীববিজ্ঞানের সবচেয়ে মৌলিক বিষয়ে।

যারা ভাবছেন অতিরঞ্জিত কথাবার্তা বলছি, একটু পড়াশুনা করলেই বুঝবেন, প্রাণের উৎপত্তির পর সাড়ে তিনশ কোটি বছরে এ সমস্ত প্রাণীজগৎ কোত্থেকে আবির্ভূত হলো তার কী চমৎকার সরল ব্যাখ্যা এই বিবর্তন তত্ত্ব। আমরা কী, কোথা থেকে এলাম, আর কোথায়ই বা যাচ্ছি — মৌলিক এ প্রশ্নগুলোর সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা পাওয়া যায় কেবলমাত্র বিবর্তনের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলেই। জীববৈচিত্র্যের কথা বাদ, শুধু নিজের শরীরের যেকোন একটা অঙ্গের দিকে তাকান। এর কাজ কী, কেন দরকার, আর কীভাবেই বা উৎপত্তি — এ প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজতে হয় জৈববিবর্তনের আলোকে। এরপর ধরেন, কী খাই, কেন খাই, শরীরের জন্য এসব ভালো না খারাপ, তার জবাবও পাওয়া যায় বিবর্তনবাদে। মনোবিজ্ঞান? সেখানেও বিবর্তনবাদ। এসব নিয়ে অন্য কোনদিন বলবো, আজ আলসেমি লাগছে।